হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহঃ) পিতার নাম হযরত ওয়ারেস আলী এবং পিতামহ ছিলেন হযরত সাইয়েদ হারেস আলী। মাতার নাম হযরত সাইয়েদা শায়িদা খাতুন। হযরত সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী ক্বিবলা কা’বার (রহঃ) দুই ভ্রাতা ও এক ভগিনী ছিলেন। তাঁহার বোন সাইয়েদা সালেহা খাতুন ছিল জ্যেষ্ঠা। তাঁহার বড় ভাই হযরত সাইয়েদ সালেহ আলী ছিলেন অবিবাহিত। যুবক অবস্থায় তিনি নির্জন অরণ্যে গমন করে ইবাদতে মশগুল থাকিতেন। তিনি খুব দয়ালু এবং কোরআনে হাফেজ ছিলেন। সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী তাঁহার পিতার কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন।

যখন তাঁহার পিতা ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে হযরত সাইয়েদ শহীদ আহমদ ব্রেলভি’র সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দেন, তিনি তখন সবেমাত্র যৌবনে উপনীত হয়েছেন। তাঁহার জ্যেষ্ঠা ভগিনী সাইয়েদা সালেহা খাতুন পিতার নিকট শিক্ষা লাভ করতেন। তিনি পিতার তত্ত্বাবধানে আধ্যাত্মিক সাধনা-শক্তি অর্জন করেন। বাংলাদেশের চট্টগ্রামের অন্তর্গত আমিরা বাজারে তার বিবাহ হয় এবং একমাত্র পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তারপর তাঁহার স্বামীর মৃত্যু হয়। বিধবা হবার কয়েকদিন পর তিনি পরলোক গমন করেন। যুবক বয়সে তাঁহার পুত্রেরও মৃত্যু হয়। তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভগিনীর পরিবারে এ ছিল এক বিয়োগান্তক পরিণতি।

তাঁহার পিতা সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভি’র সঙ্গে যুদ্ধে যোগদানের পর তিনি ও তাঁহার ভ্রাতা এক গভীর অরণ্যে যান আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন করতে। তাঁহারা সেখানে দিবারাত্র আল্লাহর সাধনায় মন প্রাণ সমর্পণ করে কয়েক বৎসর কাটান।

ক্ষুধার্ত হলে বনে যখন তাঁদের খাদ্যের প্রয়োজন হত তখন আল্লাহর অলৌকিক শক্তিতে তাঁরা খাদ্য লাভ করতেন এবং বনের ফল ভক্ষণ করতেন। হঠাৎ তাঁরা এক দৈবশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তির সাক্ষাৎ লাভ করেন। দৈবশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি আত্মপরিচয় দিয়ে বলেন তিনি হযরত খেজের (আঃ)। তিনি তাঁদেরকে আধ্যাত্মিক শক্তিতে বলিয়ান করে তোলেন। হযরত খেজের (আঃ) জানান যে তাঁদের পিতা সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভির সঙ্গে যুদ্ধ ক্ষেত্রে মারা গিয়াছেন। তারা যেন এখনই গৃহে প্রত্যাবর্তন কর। তারপর তারা গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা পুনরায় কিছুদিনের জন্য চট্টগ্রামের অরণ্যে ফিরে যান। তারপর আর কখনও তাঁর দেশে ফিরে যান নি। অদ্যাবধি তাঁহার আর সন্ধান পাওয়া যায় নি। কেউ কেউ বলেছেন তাঁহার বড় ভাই সালেহ আলী বার্মা চলে যান এবং সেখানেই বসবাস করেন।

তিনি তাঁর দেশের বাড়িতে মায়ের সঙ্গে কিছুকাল অতিবাহিত করেন। তাঁদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব স্বচ্ছল ছিল। কিন্তু কোনো কিছুর জন্য তার চাহিদা ছিল না। তিনি তাঁর পৈতৃক গৃহে পিতার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে শিশুদের শিক্ষাদান শুরু করেন।

অরণ্য প্রত্যাবর্তনের পর কয়েক মাস অতিবাহিত হল। মাতৃ অভিলাষ অনুসারে হজ্ব যাত্রার উদ্দেশ্যে তাঁরা কলিকাতা বন্দর থেকে জাহাজে মক্কা পাড়ি দিলেন । কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে হুগলী নদীর মোহনায় জাহাজ ডুবি হলো। সমস্ত হজ্ব যাত্রী ভেসে গিয়ে সলিল সমাধি হল। কিন্তু আল্লাহর অসীম করুণায় কেউ যেন হযরত ফতেহ্ আলী ওয়াইসীকে নদীর তীরে আছড়ে নিক্ষেপ করল। আশ্চর্যজনক ভাবে রক্ষা পেল তাঁর জীবন। তাঁর আরাধ্য কর্মসম্পন্ন করার জন্য আল্লাহ্ এই ভয়ানক বিপদ থেকে তাকে রক্ষা করেন। এইভাবে তিনি যৌবনে পিতামাতা, ভ্রাতা, ভগিনী একে একে পরিবারের সকলকে হারান। তাঁকে প্রতিপালনের জন্য পৃথিবীতে আর কেউ ছিল না, এটা তাঁর জীবনের এক বিয়োগান্ত কাহিনী।


কিছুদিন কলিকাতার তালতলায় গৃহ শিক্ষকতার কাজ করেন। তিনি কলিকাতায় এক ধর্মীয় সভায় ভাসন দেন। সেই সভায় উপস্থিত জ্ঞানীগুনী ও বিদগ্ধ মানুষজন তাঁর বক্তব্য হৃদয়ঙ্গম করেন। সকলে তাঁকে সমর্থন ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময় প্রকাশ করেন। সেই সভায় মুর্শিদাবাদের জনাব এমদাদুল হক ছিলেন। তিনি ছিলেন পন্ডিত ও ধার্মিক ব্যক্তি কলিকাতা নগর দেওয়ানী আদালতের উকিল। তাঁর স্ত্রী ফাতেমা খাতুন জমিদারের একমাত্র কন্যা ছিলেন। তাঁর বিবাহ হয়েছিল নানাজির বাড়ী পুনাশীতে। তাঁর স্ত্রীর নানাজীও জমিদার ছিলেন। ফলে নিজস্ব জমিদারী, স্ত্রী ও নানার শ্বশুরের জমিদারীর তিনি মালিক হলেন। তিনি তাঁকে মুর্শিদাবাদের পুনাসিতে গৃহ শিক্ষকতার জন্য বিনীত অনুরোধ জানান। আল্লাহ্ কর্তৃক অনুগৃহীত কোনো ব্যক্তি নিজেকে একস্থানে সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন না। অতঃপর তিনি প্রত্যাবর্তন করেন কলিকাতায়। তিনি কোরআন হাফেজ ছিলেন। কলিকাতায় আগমনের পর তিনি আলিয়া মাদ্রাসা সহ অন্যান্য মাদ্রাসায় অনাবাসিক অধ্যাপকের পদ অলস্কৃত করেন।

তিনি ইংরেজী, বাংলা, ফার্সী এবং উর্দু ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। কিন্তু পত্র লেখা বা মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় মূলত ফার্সী ভাষা ব্যবহার করতেন। কখনও কখনও তিনি উর্দুতেও লিখিতেন। শৈশবের শুরুতে তিনি ফার্সী ভাষায় কবিতা লিখতেন। সেই সময় রাজভাষা ছিল ফার্সী। তাঁহার হস্তক্ষর ছিল অতি সুন্দর। তিনি স্বহস্তে পবিত্র কোরআন শরীফের অনুলিপি করেন। তিনি বহু গ্রন্থও লেখেন। এইভাবে তিনি সারাজীবন সংগ্রাম করেন। মুর্শিদাবাদের পুনাশীতে থাকাকালীন সময় প্রায় ৩ একর জমির উপর বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন বনঔষধী গাছ এনে মানুষের কল্যাণের জন্য একটি বাগান তৈরী করেছিলেন। এই বাগানের নাম দিয়েছিলেন ভুবন বাগান। আজও ধ্বংস প্রায় সেই বাগান পুনাশীতে আছে। তিনি পুনাশীতে নিজ স্ত্রীর ইচ্ছানুসারে একটি একতলা বাড়ি তৈরী করেন।

Loading

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *